বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী কিছু অসাধারণ স্থান, যা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। ইতিহাস আর প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ওই সব স্থাপনার কোনো কোনোটির স্থাপত্যশৈলী আর নির্মাণ প্রক্রিয়া এখনো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছে। এসব স্থানে ভ্রমণ শুধু মনের পিপাসাই মেটায় না, বরং এ যেন বহু বছর আগের সময়কে ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা। এগুলো একদিকে ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয়, অন্যদিকে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্বপ্নপূরণের ঠিকানা। ইউনেসকো–ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, এমন কয়েকটি স্থানে ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।
কলোসিয়াম, ইতালি

পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য রোমের কলোসিয়াম। এটি প্রাচীন ইতিহাসের প্রতীকী স্থাপনাগুলোর একটি, যেটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে স্থান পেয়েছে।
রোমের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটারটি ফ্ল্যাভিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার নামেও পরিচিত। অ্যাম্ফিথিয়েটার হচ্ছে একটি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার উন্মুক্ত মঞ্চ, যার চারদিকে ধাপে ধাপে বসার জায়গা থাকে, যেন দর্শকেরা নিচের মঞ্চ বা কেন্দ্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখতে পারেন।
রোমের কলোসিয়াম বিশ্বের বিখ্যাত নিদর্শনগুলোর একটি। খ্রিষ্টের জন্মের পর ৭২ সালে এই কলোসিয়াম নির্মাণ করা হয়। একসময় এখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রাণঘাতী লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো।
গিজার পিরামিড, মিসর
গিজার পিরামিড এমন একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে অভিজ্ঞতা কেমন হবে, তা নির্ভর করে আপনি কখন ও কীভাবে সেখানে ঘুরতে গেছেন, তার ওপর। ভুল সময়ে গেলে বা ভুল ট্যুরে গেলে এটি বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতায় পরিণত হতে পারে। কারণ, সারা বিশ্ব থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পর্যটনকেন্দ্র দেখতে আসেন। ফলে বেশির ভাগ সময়ই স্থানটি ভিড়ে ঠাসা থাকে।
পর্যটনের ভুল সময় বেছে নিলে আপনি ভিড়ে পড়ে যেতে পারেন। সেখানে ট্যুর গাইডের বেশে অনেক প্রতারক ঘুরে বেড়ান, তাঁদের চক্করে পড়ে গেলে বিপদ হতে পারে। সঙ্গে বাসে গাদাগাদি ভিড় থাকায় আপনি হয়তো গ্রেট পিরামিডের সৌন্দর্য আস্বাদনের সময় ঠিকভাবে পান না। তবে এসব অসুবিধা থাকার পরও গিজার পিরামিড নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর দর্শনীয় স্থান।
এখানে উটের পিঠে, বাসে, ব্যক্তিগত ট্যুরে ঘোড়ায় টানা গাড়ি, এমনকি সাইকেলেও পিরামিড ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে উটের পিঠে চড়ে গিজা মালভূমি ঘুরে দেখা।
গিজার গ্রেট স্ফিংস, মিসর

এটি গিজার সেই মন্দির প্রাঙ্গণ, যেটি গঠিত হয়েছে গ্রেট স্ফিংস এবং খুফু, খাফরে ও মেনকাউরের তিনটি মন্দির নিয়ে। গ্রেট পিরামিডের সামনে যে ভঙ্গিতে স্ফিংস দাঁড়িয়ে আছে, তা যে কারও কাছে অবাস্তব বা পরাবাস্তব কিছু মনে হতে পারে।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নির্মিত গিজার পিরামিডই হলো একমাত্র স্থাপনা, যেটি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি ছিল এবং এখনো টিকে আছে।
গিজার পিরামিডগুলো নিজের চোখে দেখার সময় আপনার মনে হতে পারে এও কি সম্ভব, সত্যিই কি মানুষ এগুলো তৈরি করেছে। এত আগে কীভাবে এত বিশাল ও নিখুঁত এই স্মৃতিস্তম্ভগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, কোন বলেই–বা এগুলো হাজার হাজার বছর ধরে অটুট আছে?
মেম্ফিস শহর এবং তার আশপাশের সমাধিক্ষেত্র, যার মধ্যে গিজা থেকে দাহশুর পর্যন্ত বিস্তৃত পিরামিড অঞ্চলকে ১৯৭৯ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গিজার গ্রেট স্ফিংস ও পিরামিড কমপ্লেক্স ইতিহাস, স্থাপত্য ও রহস্যের এক অনন্য মিশ্রণ, যা বিশ্বের যেকোনো পর্যটকের জন্য এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
অ্যাক্রোপলিস, গ্রিস

এথেন্স পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। শহরটি অসাধারণ সব স্থাপত্য ও দারুণ সব ধ্বংসাবশেষে ভরপুর।
এথেন্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম অ্যাক্রোপলিস। ১৯৮৭ সালে ইউনেসকো অ্যাক্রোপলিসকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি দেয়।
পার্থেনন হলো অ্যাক্রোপলিসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা, যা দেবী অ্যাথেনার উদ্দেশ্যে নির্মিত। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি এই অবকাঠামোর কাছ থেকে চারপাশে শহরের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
অ্যাক্রোপলিসে হাঁটতে হাঁটতে যেন মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। সেখানে রয়েছে গ্রিক দেবী অ্যাথেনার মন্দির, নাইকের মন্দির, ওডিয়ন অব হেরোডেস অ্যাটিকাস থিয়েটারসহ আরও অনেক কিছু।
এই অসাধারণ স্মৃতিস্তম্ভটি দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে গর্ব ভরে এথেন্স শহরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
চিচেন ইৎসা, মেক্সিকো

মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত চিচেন ইৎসা একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
মায়া সভ্যতা ও তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির চিহ্ন বহন করা চিচেন ইৎসাকে বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইউনেসকো–ঘোষিত এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
কানকুন শহর থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় পুরো দিন হাতে নিয়ে চিচেন ইৎসা ঘুরতে যাওয়া উচিত। সেখানে একটি সেনোতে (প্রাকৃতিক জলাধার) এবং ঔপনিবেশিক আমলের শহর ভায়াদোলিদ ঘুরে দেখার সুযোগও রয়েছে।
চীনের মহাপ্রাচীর, চীন

বেইজিং শহরের বাইরেই অবস্থিত চীনের মহাপ্রাচীরের বিশালতা যে কাউকে বিস্মিত করবে।
বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃত এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করা যায়, যার মধ্যে বাদালিং ও মুতিয়েনইউ অংশে সবচেয়ে সহজে পৌঁছানো যায়। যদিও এই দুটি জায়গা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা।
চীনের মহাপ্রাচীরকে ১৯৮৭ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রায় তিন হাজার বছর পুরোনো এই প্রাচীর আমাদের প্রাচীন পৃথিবীর একঝলক দেখায়।
আসলে এটি কিন্তু একটি প্রাচীর নয়, বরং বহু অংশে তৈরি করা নানা প্রাচীর একত্র করে তৈরি হয়েছে এই মহাপ্রাচীর।
চীনের বিবাদমান রাজ্যগুলো যখন সম্রাট কিনের শাসনে একত্র হয়, তখন নানা প্রাচীর একটি আরেকটির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে চীনের মহাপ্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসব হয়েছে।
মহাপ্রাচীরের বাদালিং অংশটি বেইজিংয়ের সবচেয়ে কাছের হওয়ায় স্থানীয় পর্যটকে ভরে থাকে, যা একে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। অন্যদিকে, মুতিয়েনইউ অংশটি শহর থেকে খানিকটা দূরে, তাই এখানে ভিড় কম, কিন্তু সৌন্দর্যে একটুও কম নয়।
উত্তরের যাযাবর জাতিগুলোর আকস্মিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই প্রাচীর এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তী রাজবংশগুলো এই প্রাচীর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে তাদের দুর্গ সুরক্ষিত রাখতে।
পেতরা, জর্ডান

‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’, ‘আলাদিন’, ‘ট্রান্সফরমারস আর দ্য মামি রিটার্নস’—এর মতো সিনেমার শুটিং হয়েছে জর্ডানের পেতরায়। এটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে নির্মিত পেতরা জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। যদিও খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই বেদুইনরা এই জায়গা ব্যবহার করতেন, কিন্তু বাইরের বিশ্ব এটি আবিষ্কার করে মাত্র ২০০ বছর আগে।
সুইস অভিযাত্রী জোহান লুডউইগ বার্কহার্ট ১৮১২ সালে এ স্থান ভ্রমণের আগপর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অজানা ছিল পেতরা, যা সত্যিই আশ্চর্যের।
লোহিত সাগর ও মৃত সাগরের মধ্যে একটি প্রধান বাণিজ্য পথের মাঝে পড়ায় প্রাচীনকালে বণিক দল এই শহরে বিশ্রাম নিত। ১৯৮৫ সালে একে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তাজমহল, ভারত

ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা তাজমহল। মোগল আমলে নির্মিত এই স্থাপনা বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি। ভারতের আগ্রা শহরে অবস্থিত তাজমহলকে ভালোবাসার প্রতীকী সৌধ বলা হয়। সপ্তদশ শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রয়াত স্ত্রী মমতাজের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এটি নির্মাণ করেছিলেন।
তাজমহল নির্মাণে ২০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। ১৯৮৩ সালে তাজমহল ইউনেসকো–ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং পরে একে নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি ঘোষণা করা হয়।
তাজমহলের সৌন্দর্য ও ইতিহাস একে ভালোবাসা, শিল্প ও স্থাপত্যের এক অনন্য মিশ্রণ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তুলেছে।
তিকাল, গুয়াতেমালা
গুয়াতেমালার তিকাল ধ্বংসাবশেষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অন্যান্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে খানিকটা আলাদা হবে। এই স্থানের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো জঙ্গলে ঢাকা পিরামিড।
তিকাল ন্যাশনাল পার্কে মাটির ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া পিরামিডগুলো যেন জানান দেয়, নিচে লুকিয়ে আছে অসাধারণ কিছু। এই জঙ্গলঘেরা পরিবেশই তিকালকে বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের পছন্দের স্থান করে তুলেছে।
তিকাল ছিল মায়া সভ্যতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, যার ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ১৯৭৯ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। গুয়াতেমালার উত্তরে অবস্থিত এই ধ্বংসাবশেষকে অনেকেই বিশ্বের সেরা মায়া নিদর্শন বলে মনে করেন।
৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত মন্দিরগুলো অবিশ্বাস্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এর মধ্যে নর্থ অ্যাক্রোপলিস-১ সবচেয়ে উঁচু ও চমকপ্রদ আর সেভেন টেম্পলস প্লাজা তিকালের অন্যতম বড় প্লাজা।
এখানে প্রায় সব ধ্বংসাবশেষেই ওঠা যায়, সূর্যোদয়ের সময়ের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে অনেক পর্যটক আলো ফোটার আগেই তিকাল ন্যাশনাল পার্কে চলে যান। কুয়াশায় বানরের ডাক আর গাছের চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা সত্যিই অভাবনীয়।
মাচুপিচু, পেরু

মাচুপিচু বিশ্বে নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি আর এর যথেষ্ট কারণও আছে। এটি একযোগে ইউনেসকো–ঘোষিত সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি একটি অবশ্যদেখার জায়গা। এই প্রাচীন ইনকা শহরটি পেরুর আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে অবস্থিত।
১৯১১ সালে পশ্চিমা বিশ্বের সামনে এই জায়গা উন্মোচিত হয়। তখন থেকেই মাচুপিচুতে পর্যটকদের সংখ্যা শুধু বেড়েছে। এখন বছরের অনেকটা সময় এটি ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়ে ঠাসা থাকে।
তবে শুধু প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে নয়, মাচুপিচু আসলে তার অবস্থান দিয়েই বেশি মুগ্ধ করে। ইটের তৈরি সিঁড়ির মতো ছাদের ব্লকগুলো খাঁড়াভাবে নিচের উপত্যকার দিকে নেমে গেছে, যা একে করে তুলেছে অনন্য।
কুসকো শহর থেকে ট্রেনে মাচুপিচু যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। চাইলে চার দিন ধরে ইনকা ট্রেইল ধরে হেঁটেও মাচুপিচুতে পৌঁছানো সম্ভব, যা আপনাকে দিতে পারে অনন্য এক অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা হয়তো কোনো দিন আপনি ভুলতে পারবেন না। তবে ট্রেইল ধরে হাঁটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আর ভিড় সামাল দিতে পেরু সরকার প্রতিদিনের পর্যটক সংখ্যাও সীমিত করেছে।
তথ্যসূত্র: দ্য প্লানেট ডি ডটকম