ভ্রমন

নদীপথে সিলেটের লোভাছড়ার লোভনীয় সৌন্দর্যের খোঁজে

পূর্ব বাজার থেকে কালক্রমে পুববাজার হয়ে ওঠা সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার খেয়াঘাট থেকে আমাদের দেড় হাজার টাকায় ভাড়া করা ‘ছাতকী নৌকা’ যাত্রা শুরু করে। উদ্দেশ্য সীমান্তবর্তী লোভাছড়ায় যাওয়া। বার কয়েক লোভাছড়ায় গেলেও বর্ষায় কখনো এদিকটায় যাওয়া হয়নি। তবে পরিচিতজনদের মুখে বর্ষায় লোভাছড়ার অনিন্দ্য সৌন্দর্যের বয়ান আমাদের অনেক আগেই লোভাতুর করে তুলেছিল।

গত শুক্রবার পুরো একটা বিকেল রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভেসে বেড়াই লোভাছড়ার মায়াবী জলে। ভারতের মেঘালয়ের ঘন সবুজ-শ্যামল পাহাড়ের পাদদেশে থই থই পানিতে ভাসমান নৌকায় বসে বৃষ্টিতে স্নাত হই। কী অপূর্ব এক অনুভূতি!

কানাইঘাট উপজেলা সদরের সুরমা নদীর পুববাজার খেয়াঘাট থেকে বেলা পৌনে দুইটার দিকে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। এর আগে খেয়াঘাটে থাকা একাধিক মাঝির সঙ্গে দরদাম শেষে একজনের সঙ্গে বনিবনা হওয়ায় তাঁর ছইবিহীন ‘ছাতকী নৌকা’ ভাড়া করা হয়। একপর্যায়ে নদীতীরের দুই পাশের গাছগাছালি আর গাঁওগেরাম দেখতে দেখতে আমাদের যাত্রা চলে। তীব্র ভাঙনে নদীতীরবর্তী বাঁ পাশের গ্রামগুলো অনেকটাই ক্ষত-বিক্ষত!

নদীতীরের দুই পাশের গাছগাছালি আর গাঁওগেরাম দেখতে দেখতে যাত্রা চলে
নদীতীরের দুই পাশের গাছগাছালি আর গাঁওগেরাম দেখতে দেখতে যাত্রা চলেছবি: প্রথম আলো

পানি কেটে কেটে স্রোতের বিপরীতে চলছে আমাদের নৌকা। কখনো-সখনো এপাশ-ওপাশ হচ্ছে পাথরবোঝাই বড় বড় স্টিলবডি নৌকার পাশাপাশি যাত্রীবাহী ‘ছাতকী নৌকা’ও। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল থেমেছে সপ্তাহ দুই আগে, তবে সে চিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। বেশ কয়েক দিন ঢলের পানিতে ডুবে সদ্য ভেসে ওঠা তালবেগুনের পাতাহীন গাছ বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নানা জাতের গাছের পাতারা পচে-গলে ঝরে গেছে, বাকল কষে সাদা-ধূসর হয়ে আছে গাছের ডালও। কিছু কিছু গাছের মগডালে বসে রং-বেরঙের পাখিরা খুনসুটি করছে।

নৌকা এগোচ্ছে আর নান্দনিক দৃশ্যগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ভারতের অংশে থাকা কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী দূরের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে! আর আমাদের গন্তব্যও সেই পাহাড়ের পাদদেশ। সেখানে যেতে যেতেই চোখে পড়ল ঘাসের খোঁজে নদীপাড়ে চরে বেড়াচ্ছে গরু, বাঁশঝাড়ে উড়ছে চড়ুই, শালিক। মাঝ নদীতে হাতে বাওয়া নৌকায় করে মাছ শিকারে ব্যস্ত আছেন জেলেরা। ঘাটে ঘাটে নৌকা নোঙর করা। সুরমা নদীর এপার-ওপার বৈদ্যুতিক তার দিয়ে সংযোগকারী দুই খুঁটি বসা অসংখ্য দাঁড়কাক।

সুরমা নদীর এক পাশ চলে গেছে তার উৎসমুখ ভারতের দিকে, অন্যদিক কানাইঘাটমুখী
সুরমা নদীর এক পাশ চলে গেছে তার উৎসমুখ ভারতের দিকে, অন্যদিক কানাইঘাটমুখীছবি: প্রথম আলো

লোভা নদীর ত্রিমোহনায় এসেই বিস্ময়ের পালা। এটাই লোভার উৎসস্থল। অবশ্য ত্রিমোহনা না বলে চৌমোহনা বলাই শ্রেয়। সুরমা নদীর এক পাশ চলে গেছে তার উৎসমুখ ভারতের দিকে, অন্যদিক কানাইঘাটমুখী। এখানেই লোভা নাম ধারণ করে নদীটি চলে যায় কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী কানধলা, সাউদগ্রাম, বড়গ্রাম আর মুলাগুল বাজারের দিকে। নদীতে প্রবাহিত এই তিন শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে একটি খাল, নাম ‘দেওছই’। মূলত এই দেওছইয়ের কারণেই এ অংশটাকে কেউ কেউ চৌমোহনাও বলে থাকেন।

ত্রিমোহনা কিংবা চৌমোহনা—যাই বলি, লোভার এই উৎসমুখ থেকেই দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়গুলো। এতক্ষণ ঘন কালোমতো রূপে থাকা পাহাড়গুলো এখন অনেকটাই সবুজ দেখাচ্ছে। সারি সারি পাহাড়ের নিচেই ছোট ছোট কিছু টিলা। সেসব টিলায় ঠিকরে পড়ছে সূর্যের আলো। উজ্জ্বল, নির্মল আর প্রাণদায়ী রৌদ্রের স্বচ্ছতায় ঝলমল করছে এসব টিলা। টিলাগুলো ঘেঁষেই যেন থম ধরে আছে উন্মুক্ত আকাশ! শ্বেতশুভ্র মায়াবি এক পরিবেশ। যেন শিল্পীর আঁকা কল্পনার কোনো জগৎ!

স্বচ্ছ জলের লোভার পানিতে দোল খাচ্ছে নৌকা
স্বচ্ছ জলের লোভার পানিতে দোল খাচ্ছে নৌকাছবি: প্রথম আলো

নৌকা চলছে। চিন্তারবাজার পেরিয়ে একসময় আমরা আসি ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী গ্রামীণ হাট বাগিচাবাজারে। লোভাছড়া চা-বাগানকে বাঁ দিকে রেখে আমরা একটা সময় পৌঁছে যাই মুলাগুল বাজারের ঠিক পাশে। এই বাজারলাগোয়া দুটি গ্রাম সাউদগ্রাম ও বড়গ্রাম। এ দুটি গ্রামের ঠিক বিপরীতেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। দূর থেকে এতক্ষণ ধরে মেঘালয়ের যেসব পাহাড়গুলোকে অতি দূরের কোনো কল্পনাজগৎ মনে হয়েছিল, আমরা এখন এসব পাহাড়ের ঠিক পাদদেশেই প্রবাহিত লোভাছড়ার পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছি।

এতক্ষণ সূর্যের দাপটে থাকা আকাশ হঠাৎ করেই কালো হয়ে যায়। একদিকে দল বেঁধে, আরেক দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, স্বচ্ছ জলের লোভার পানিতে দোল খাচ্ছে নৌকা। ঠিক পাশেই কয়েক শ গজ দূরে মেঘালয়ের সারি সারি পাহাড়। সেসব পাহাড় ঠাসা নানা প্রজাতির সবুজ গাছগাছালিতে। পাহাড়ের গোড়ায় ধাক্কা দিচ্ছে লোভার ছোট-বড় ঢেউ।

একদিকে দল বেঁধে, আরেক দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে
একদিকে দল বেঁধে, আরেক দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়েছবি: প্রথম আলো

সীমান্তের শেষ সীমানায় অবস্থান নিয়ে পাহাড়-জলের এমন রোমান্টিক খুনসুটি দেখতে দেখতেই বৃষ্টি নামে। প্রথমে রিমঝিম, পরে মুষলধারে। বৃষ্টি, পাহাড়, স্বচ্ছ জল, উন্মুক্ত আকাশ, সবুজ গাছগাছালি—কী অপরূপ এক নান্দনিক মুহূর্ত! সঙ্গে থাকা এক ছাতায় আমাদের তিনজনের ঠাঁই হয় না, নদীও ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে তাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই আমরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি। কাকভেজা হয়ে স্থানীয় মুলাগুল বাজারে যখন আমাদের নৌকা ভেড়ে, তখন বৃষ্টির ভয়াবহতা আরও বাড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *